বেদের মেয়ে জোসনা আমায় কথা দিয়েছে
বেদের মেয়ে জোসনা আমায় কথা দিয়েছে,
আসি আসি বলে জোসনা ফাঁকি দিয়েছে।আমি যখন রাঁধতে বসি বন্ধু বাজাও বাঁশি,
রান্না বাড়া রেখে আমি কেমন করে আসি।
আপনার জন্ম যদি ৮০ কিংবা ৯০ দশকে হয়ে থাকে। আমার ধারনা, আপনি কোনো না কোনোভাবে ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ গানের সাথে পরিচিত হবেন। তোজাম্মেল হক বকুলের লেখায় গানটিতে কন্ঠ দিয়েছিলেন, প্রয়াত এন্ড্রু কিশোর ও রুনা লায়লা।
১৯৮৯ সাল, বাংলাদেশে তখন স্বৈরাচারবিরোধী (এরশাদবিরোধী) আন্দোলন চলছে। সে এক ঘোর লাগা সময়, সমগ্র দেশ উত্তাল। সে সময়েই মুক্তি পায় তোজাম্মেল হক বকুল পরিচালিত ‘বেদের মেয়ে জোসনা’। এতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন অঞ্জু ঘোষ এবং তার বিপরীতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে ইলিয়াস কাঞ্চন। প্রায় ১২০০টি প্রেক্ষাগৃহে সিনেমাটি মুক্তি পায়। আয় করে প্রায় ২০ কোটি টাকা। যা আজ অবধি বাংলাদেশের সর্বাধিক ব্যবসাসফল সিনেমা।
বেদের মেয়ে জোসনার আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিলো, এর মূল থিম ছিলো পল্লীকবি জসীম উদদীনের ‘বেদের মেয়ে’ থেকে নেয়া। এ গ্রন্থের প্রথম সংস্করণ বেরিয়েছিলো ১৯৫১ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি লাইব্রেরী থেকে।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য এই যে, বেদের মেয়ে জোসনা মুক্তির প্রথম দু-তিনদিন ছবিটি দেখতে সিনেমা হলে তেমন দর্শকও আসেনি। কিন্তু কয়েকদিন পরই প্রতিটি হলেই বাড়তে থাকে দর্শক, যা হয়ে দাঁড়ায় ইতিহাসের অংশ। এমনও হয়েছে কোন কোন হলে টানা চার-পাঁচ মাসও চলেছে।
একটি রাজ্যের কাজী সাহেবের (প্রবীর মিত্র) দশ বছরের মেয়েকে (অঞ্জু ঘোষ) সাপে কাটলে তাকে বাঁচিয়ে তোলার প্রচলিত সকল চিকিৎসা ব্যর্থ হয়। তখন শেষ চিকিৎসা হিসেবে তাকে নদীতে কলার ভেলায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়। সেই ভেলা এক সময় একটি বেদে বহরের কাছে এলে নিঃসন্তান বেদে সর্দার (সাইফুদ্দিন) ও তার স্ত্রী (রওশন জামিল) মেয়েটিকে ভালো করে তোলে। নিজেদের নাতনি হিসেবে বড় করে তোলে।
একদিন পথিমধ্যে রাজের উজিরপুত্র মোবারক (নাসির খান) জোসনাকে (অঞ্জু ঘোষ) রেপ করতে চাইলে রাজকুমার আনোয়ার (ইলিয়াস কাঞ্চন) এসে জোসনাকে উদ্ধার করে। ঘটনার প্রবাহে এক সময় তাদের প্রেম হয়ে যায়।
রাজা যখন যুবরাজ আনোয়ারের সঙ্গে উজির কন্যা (ফারজানা ববি-র) বিয়ে দিয়ে রাজ্যের সকল ভার ছেলেকে বুঝিয়ে দেবেন ঠিক তখনই তাকে এক বিষধর সাপ দংশন করে। এমন অবস্থায় রাজ্যের কোন সাপুড়ে সাপের বিষ নামাতে রাজি হয় না, এটা এমনই বিষ যা নামাতে বাজাতে হবে মরণ বীণ।
এদিকে একজন খোঁজ দেয় জোসনা নামের একজন আছে, শুধুমাত্র সেই পারে এই বীণ বাজাতে। আর তখনই সেনাপতি পুত্র রাজ্জাক (মিঠুন) জোসনাকে নিয়ে আসে। জোসনাকে দেখে রাজসভায় রাজা সবাইকে সাক্ষী রেখে বলেন, সে যদি রাজপুত্রকে সুস্থ করে দিতে পারে তাহলে, জোসনা যা চাইবে তাই তিনি দেবেন।
নিজের চোখের সামনে জোসনা তার প্রেমিক রাজকুমারের এমন পরিণতি দেখে আর ঠিক থাকতে পারে না। তাই তো দাদা- দাদীর কথা উপেক্ষা করে হাতে তুলে নেয় মরণ বীণ। যে বীণে দংশিত সাপ না আসলে গলায় রক্ত ওঠে নিশ্চিত মূত্যু জেনেও সুর তোলে জোসনা। এক সময় নিজের জীবন বাজি রেখে আনেয়ারকে সুস্থ করে তোলে।
এবার রাজা ওয়াদা রক্ষার জন্য জোসনাকে বলে ‘কী চাই তোমার’। তখন জোসনা গানে গানে বলে উঠে, ‘কী ধন আমি চাইবো রাজা গো, ও রাজ চাই যে রাজকুমারকে’। এ কথা শোনা মাত্রই রাজা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন এবং জোসনাকে গলা ধাক্কা দিয়ে রাজসভা থেকে বের করে দিতে বলেন।
নায়িকা চরিত্রের অঞ্জু ঘোষের লোক সংস্কৃতি তথা যাত্রার ব্যাকগ্রাউন্ড ছিলো। তাই তার প্রতিবাদী জোসনা চরিত্রে রাজার মুখোমুখি হয়ে নিজের অধিকারের কথা বলতে দেখে দর্শক আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে যায়।
জোসনা তখন হয়ে যায় সমাজের সেই খেটে খাওয়া মানুষদের প্রতিনিধি, তাদেরই আপনজন। যারা সব সময় শাসক দ্বারা নির্যাতনে স্বীকার হয়ে আসছে। ঠিক যেমনটা প্রতিবার রাজনৈতিক নেতারা ভোটের আগে আমাদের বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দেয়।
আবার অনেকের মতে, অহংকারী রাজার সামনে জোসনার প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর তখনকার এরশাদবিরোধী (স্বৈরাচার) আন্দোলনের জনগণের একাত্মতার কারণে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে এ ছবির গল্প সংলাপ ও গান।
আবার ঘটনার প্রবাহে জোসনার বনবাসেও দর্শকরা অশ্রু ঝরান। জোসনা চরিত্রে কতটা আবেগ থাকলে হল ভর্তি মহিলা দর্শকরা নীরবে চোখ মুছেন! আবার এদিকে, নিজের রাজ্যের রাজকুমার হয়েও যখন চার দেওয়ালের বন্দী হয়ে ইলিয়াস কাঞ্চন গেয়ে উঠেন, ‘আমি বন্দী কারাগারে, আছি গো মা বিপদে, বাইরের আলো চোখে পড়ে না মা’— মুজীব পরদেশীর এই বিখ্যাত গানটিতে নায়কের এমন দুঃখ-কষ্টে। সে সময়ের সব পুরুষ দর্শকদেরও চোখ অশ্রুসিক্ত হয়, নায়কের এমন পরিণতি তারাও মেনে নিতে পারেনি।
সিনেমার হলের অন্ধকার ঘরে তখন সৃষ্টি হয়, অদ্ভুত এক সেলুলয়েডের মায়া।
সেময়ে ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে তার রেশ চলে গিয়েছিল পাশের দেশ ভারতের কলকাতাতেও। ১৯৯১ সালে সেখানে মতিউর রহমান পানু সিনেমাটির রিমেকও করেছিলেন। নায়ক হিসেবে সেখানকার চিরঞ্জিতকে রেখে মূল ছবির বাকী সবাইকে নিয়ে হয় রিমেক। ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ কলকাতাতেও তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো।
বিগত ৩ দিনে আমি বেদের মেয়ে জোসনা গানটা মোট ৩২ বার শুনেছি। এদিকে আবার উইকিপিডিয়া বলছে, ‘বেদের মেয়ে জোসনা’র মুক্তিরও ৩২ বছরপূর্তি হয়ে গিয়েছে।
কেমন তোমার মাতা পিতা কেমন তোমার হিয়া-
এসব কথা রেখে তুমি আমায় কর বিয়া,
আরে চল চল চল বন্ধু ঘরে ফিরে যাই,
দাদা আর দাদীরে গিয়া নিরালায় বোঝাই
বেদের মেয়ে জোছনা আমায় কথা দিয়েছে।
ছবি: সংগৃহীত
