বাংলা বর্ণমালার মতো এতো দুঃখিনী বর্ণমালা পৃথিবীতে আর কোনো ভাষায় নেই।

বাংলা বর্ণমালার মতো এতো দুঃখিনী বর্ণমালা পৃথিবীতে আর কোনো ভাষায় নেই। বাংলার মানুষ মায়ের মধুর ভাষায় কথা বলতে চেয়েছিল- যা ছিল তার জন্মগত অধিকার। কিন্তু বার বার আঘাত আসে আমার দুঃখিনী বর্ণমালার উপর- চরম আঘাত আসে ১৯৫২ সালের একুশে

ফেব্রুয়ারি- বর্বর অসভ্য নিষ্ঠুর কুখ্যাত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আমার মায়ের ভাষা তথা বাংলায় কথা বলার অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। বর্বর পাকিস্তানিরা আজব ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা রূপে অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দিতে উদ্যত হয়েছিল -সবচেয়ে অবাক লাগে আজব উর্দু ভাষা পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হলেও সে ভাষা পাকিস্তানের কোন প্রদেশের ভাষাতো নয়ই বরং তাদের অধিবাসীদের কোনো মায়ের ভাষাও নয় এবং আরো অবাক কাণ্ড এই উর্দু ভাষার নিজস্ব কোনো বর্ণমালাও নেই! মায়ের ভাষা বাংলাকে অন্যায়ভাবে মায়ের আাঁচল থেকে কেড়ে নেওয়ার প্রতিবাদে সেদিন সেই বসন্তে জ্বলে উঠেছিল আমার দুঃখিনী বর্ণমালা- রক্তাক্ত হয়েছিল আমার মায়ের অতি প্রিয় উজ্জ্বল নক্ষত্র নয়নের মণি ৫০টি বাংলা বর্ণমালা। বাঙালির গর্ব এই ৫০টি বর্ণমালাই হলো বর্বর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর চক্ষুশূল। এই বর্ণমালাকে রক্ষা করতে গিয়ে বাংলাদেশের সংগ্রামী ছাত্র-জনতা বাদ-প্রতিবাদে বিক্ষোভ মুখর হয়ে উঠে- বাংলা তথা মাতৃভাষার রক্ষার জন্য পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর গুলির কাছে বুক পেতে দেন- প্রাণ উৎসর্গ করলেন রফিক, শফিক, সালাম, বরকত, জব্বার এবং আরো অনেক নাম না জানা বীর। সেদিন ঋতুরাজ বসন্তের দক্ষিণা বাতাসে ছিল শুধু বারুদের গন্ধ! ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বীর বাঙালি শেষ পর্যন্ত বুকের তাজা রক্ত দিয়ে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত করে রক্ষা করেছে দুঃখিনী বর্ণমালাকে এবং আদায় করে নিল মায়ের ভাষা। বাংলা ভাষার মতো শক্তিশালী বর্ণমালা পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষায় নেই। এছাড়া বাংলাভাষার ব্যাকরণিক কাঠামো খুবই উন্নতমানের যা পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষার ব্যাকরণ বাংলার ধারে কাছেও নয়। বাংলা একাডেমিরপ্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণশিরোনামে দুই খণ্ডের যে ব্যাকরণ গ্রন্থ রয়েছে- তা বাংলাদেশ, পশ্চিমবাংলা, আসামের ঈষাণবাংলা ত্রিপুরার বাংলা ভাষাভাষীদের গৌরব তথা বিশ্বের ত্রিশকোটি বাঙালির এক বিরাট সম্পদ। বিশ্বের আর কোথাও কোনো জাতিকে তার বর্ণমালাকে বা মায়ের ভাষাকে রক্ষার জন্য জীবন দিতে হয়নি- অথচ বাঙালিকেই প্রথম রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে মায়ের ভাষা বাংলাকে বর্ণমালাকে রক্ষার জন্য বুকের তাজা রক্ত দিয়ে ঢাকার রাজপথ রক্তেভাসিয়েছে। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলাভাষার জন্য সালাম-বরকতরা প্রাণ দেবার পর আবারো বাংলাভাষার দাবিতে তথা মায়ের ভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ১৯৬১ সালের ১৯ মে ভারতের আসাম রাজ্যের বাঙালি অধ্যূষিত তথা ঈষাণ বাংলার শিলচরে একজন মহিলাসহ এগারো জন বাঙালি মায়ের ভাষা বাংলাকে রক্ষার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন। পৃথিবীতে শুধু বাঙালিরাই তাদের প্রিয় মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন। বাংলা ভাষার স্থান এখন বিশ্বে ৪র্থ এবং বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্যারিসে ইউনেস্কোর কাছে একুশে ফেব্রুয়ারিকেআন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসহিসেবে ঘোষণা দেয়ার প্রস্তাব পেশ করা হয়। বাংলাদেশসহ ২৭টি দেশ সেই প্রস্তাবে অংশগ্রহণ করে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর ৩৯তম প্যারিস সম্মেলনে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। সারা পৃথিবীতে মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে বাঙালিরা তথা বাংলাদেশিরা যে সংগ্রাম করে এসেছে- এটা ২১ ফেব্রুয়ারিআন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসপালনের মাধ্যমে স্বীকৃতি লাভ করল- যাআন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসপ্রস্তাবকারী সালাম রফিকের প্রয়াসের কীর্তি এবং ইতিহাসের খাতায় নতুন করে তাঁদের নামও অমর হয়ে রইল। ইউনেস্কোআন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসপালনের জন্য ২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর ইউনেস্কোর ৩৩তম অধিবেশনে সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব তৈরি করে। পরবর্তী সময়ে তা জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদে উত্থাপন করা হয়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২০০৮ সালকেআন্তর্জাতিক ভাষা বর্ষহিসেবে ঘোষণা করে। পরবর্তী সময়ে ইউনেস্কোর পর জাতিসংঘও একুশে ফেব্রুয়ারিকেআন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসহিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ঐতিহাসিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
সারা পৃথিবীতে মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে বাঙালিরা যে সংগ্রাম করে এসেছে- ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের সেই রক্তস্বাক্ষরিত দিনটিআন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসপালনের মাধ্যমে স্বীকৃতি লাভ করল- সারা বিশ্বে এখন ২১ ফেব্রুয়ারি পালিত হয়আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবসহিসেবে। বাঙালিদের আজ শুধু নিজেদের মাতৃভাষার জন্য নয়- বিশ্বের সকল মানুষের মাতৃভাষার জন্য সমর্থন সম্মান জানাতে হবে।
বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের ফেব্রুয়ারি তথা বসন্তেই বাংলার স্বাধীনতার বীজ রোপন হয়েছিল এবং তার ধারাবাহিকতায় একাত্তরের এই উত্তাল বসন্তেই আবারো জ্বলে উঠেছিল বিক্ষুব্ধ বাংলা বর্ণমালার চার অক্ষরের একটি অতি প্রিয় শব্দস্বা-ধী--তা এই বসন্তেই গাঢ় সবুজের মধ্যে রক্তিম সূর্য সম্বলিত বাংলাদেশের স্বর্ণালি মানচিত্র খচিত বাংলাদেশের নতুন পতাকা উড়ানো হয়। তাই শহীদ মিনারের পাদপীঠে দাঁড়িয়ে এদেশের মুক্তিকামী মানুষ প্রতিটি একুশে ফেব্রুয়ারিতেই দুর্জয় শপথ গ্রহণ করে- শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অঙ্গীকার, অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ভারসাম্যহীনতা অবসানের অঙ্গীকার, স্বৈরাচার অনাচার ধ্বংসের অঙ্গীকার, মিহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার।
যে বাংলা ভাষার জন্য আত্মত্যাগ করে অর্জিত হয়েছে বিশ্বের বুকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা অহঙ্কার- সেই মাতৃভাষার বিরুদ্ধে চক্রান্ত আজও থামেনি। ভাষার নামে দেশ বাংলাদেশ- এরকম ভাষার নামে দেশ পৃথিবীতে খুব কমই আছে- অথচ এই বাংলাদেশে আজও বাংলাভাষাকে বিকৃত করার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। তাই স্বাধীনতার এত বছর পরও রাজপথে নামতে হচ্ছে প্রজন্মকে বাংলাভাষা সংস্কৃতি রক্ষার আন্দোলনে। সুখের বিষয় বাংলা ভাষার পবিত্রতা সর্বদা রক্ষার লক্ষে- বাংলা ভাষার বিকৃতি চলবে না- এই মর্মে বাংলাদেশের হাইকোর্ট একটি ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন এবং আরো একটি রায়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়াসহ গণমাধ্যমের বিজ্ঞাপন, সাইনবোর্ড, গাড়ির নম্বর তথা লাইসেন্স প্লেটে বাংলাভাষা ব্যবহার করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এই দুঃখিনী বাংলায় রক্তের দামে কেনা আমার বাংলা বর্ণমালা এবং মায়ের ভাষা ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত করার চক্রান্ত দেখে কবি শামসুর রাহমানেরবর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালাকবিতার ভাষায় আজ আক্ষেপ করে বলতে ইচ্ছে করছে-
এখন তোমাকে নিয়ে খেঙরার নোংরামি,/ এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউড়ের পৌষমাস!/ তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো,/ বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।

>স্বপ্ন

রোম্যান্টিক কবির মূলশক্তি হলো কল্পনাপ্রতিভা, যা দিয়ে তিনি দেখেন এবঙ পুণর্সৃষ্টি করেন বিশ্বজগত। তিনি নিজেই তাঁর সৌরজগতের কেন্দ্র এবঙ তিনিই তৈরি করেন তাঁর দেখার সীমানা। তিনি কল্পনাপ্রতিভার সাহায্যে উপলব্ধি করেন; বাইরের চোখ দিয়ে তিনি দেখেন না, দেখেন আন্তর চোখ দিয়ে।

 


বিশ্বের শ্রেষ্ঠতর রোম্যান্টিকদের মাঝে রবীন্দ্রনাথ একজন, সম্ভবত শ্রেষ্ঠতমও। রবীন্দ্রনাথের মাঝে পাই রোম্যান্টিসিজমের শ্রেষ্ঠ প্রকাশ, যা পূর্ব-পশ্চিমের আর কারও মাঝেই তেমন একটা পাওয়া যায় না। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র, অহমিকা, মৌলিকত্ব, কল্পনাপ্রতিভা, স্বতস্ফূর্ততা, আবেগানুভূতি এবঙ আরও অনেক ব্যাপার যেমন ব্যাপক-গভীর-তীব্রভাবে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কবিতা গানে- তা আর কোথাও হয়নি। তীব্রতায় তিনি অদ্বিতীয়; বিষ্ণু দে যদিও শেলীর পরে তাঁকে রেখেছেন, আমার ব্যক্তিগত বিবেচনায় রবীন্দ্রনাথ শেলীর চেয়েও তীব্র রোম্যান্টিক। বিলেতের পাঁচ রোম্যান্টিক ওয়ার্ডওঅর্থ, কোলরিজ, শেলী, কীটস, বায়রন- মিলে যা করে গেছেন, বাঙলায় রবীন্দ্রনাথ করেছেন তারও বেশি এবঙ তিনি করেছেন একা। তিনি একাই ছিলেন এবঙ নিজেকে দেখেছেনও সেইভাবে একবাঁশিওয়ালারূপে, বারবার বলেছেন বাঁশি বাজানোর কথা, মধ্যাহ্নের অলস গায়কের মতো বাঁশি বাজানোই তাঁর আনন্দ, তিনি সমাজের নন, সব সময়ই সমাজে তিনিআগন্তুক’; তিনি প্রবেশ করেননি প্রথাগত সমাজে

 

তিনি বলছেন যে সৃষ্টিছাড়া সৃষ্টি মাঝে বহুকাল সঙ্গীহীন রাত্রিদিন বাস করেছেন, যাঁর চোখে স্বপ্নাবেশ আর শরীরে অপরূপ বেশ, আর জগতে আসার দিনকোন্ মাতাঁকে দিয়েছেনশুধু খেলবার বাঁশি কেবল রবীন্দ্রনাথের কাব্য নয়, হলো রবীন্দ্রনাথের আমুত্যৃ উপলব্ধি। এমন উপলব্ধি কীটসেরঅৌড টু দ্যা নাইটেঙ্গেলবাদ দিলে আর কোনো ইঙরেজী রোম্যান্টিক কবিতায়ও পাই না। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতায় অষ্টাদশ শতকের রোম্যান্টিকতায় অবগাহন করেছিলেন বটে, কিন্তু তিনি সেখানেই তাঁর যাত্রাকে থামিয়ে দেননি; বরঙ তিনি দেখিয়েছিলেন ক্লাসিসিজম নব্য-ক্লাসিসিজমের বিরোধীতাই কেবল রোম্যান্টিকতা নয়; অনুভবের অন্তস্থলের অবচেতনাও রোম্যান্টিকতার এক অবিচল প্রবণতা। তিনি নিজেকে যে ধারায় ভাঙতে চেয়েছিলেন, তা পারেননি- তিনি ছিলেন মূলত বহিস্থিত, এবঙ সকল সময়ের আগন্তুক- আর ছিলেন নান্দনিক প্রকাশময়তার উজ্জ্বল সারথি। তাই কিশোর বয়সের যে কাব্যগুলো তিনি বাতিল করেছেন, সেইকবিকাহিনী’, ‘বনফুল’, ‘ভগ্নহৃদয়’, ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’- তার মধ্যেও আমরা এক নিবিড় রোম্যান্টিক রবীন্দ্রনাথকে পাই, যিনি বিব্রতবোধ করেছিলেন নিজের কৈশোর জীবনের নিজস্বতাকেন্দ্রীক বহিরস্থিততাকে। 


রবীন্দ্রনাথ বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রোম্যান্টিক কবি রবীন্দ্রনাথ বাঙালি জাতির জন্যে যা দিয়ে গেছেন, তা দিয়ে বাঙালি নির্বিঘ্নে পৃথিবীর ইতিহাসে বেঁচে থাকবে আগামী অন্তত এক হাজার বছর। তারপর বাঙালি সম্ভবত আর টিকে থাকবে না; কারণ টিকে থাকার মতো কিছুই করছে না বাঙালি, এমনকি পড়ছে না রবীন্দ্রনাথও। 

 

Blogger দ্বারা পরিচালিত.