পৃথিবীর রহস্যময় যত জাহাজ

মুদ্র মানেই অভিযানের গল্প। সাগরের বুকে কতশত কাহিনিই না কালে কালে তৈরি হয়েছে। সেগুলোর কোনোটি বিজয়ের আবার কেনোটি হারানোর। সাধরণ সেসব কাহিনির পাশাপাশি সমুদ্রকে ঘিরে রহস্যময় ঘটনার সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। এই প্রতিবেদনে এমন কিছু রহস্যজনক ঘটনার কাহিনি তুলে ধরা হচ্ছে যেগুলোতে উঠে এসেছে সমুদ্র ও সমুদ্রে ভাসমান অদ্ভূত কিছু জাহজের গল্প।

পৃথিবীতে এমন কিছু জাহাজের কথা জানা যায় যেগুলোকে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য রহস্য। এর কোনো কোনোটিকে আবার ভূতুড়ে হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়েছে। 

★ আসুন জেনে নিন এমনই ভূতুড়ে আর রহস্যভরা কিছু জাহাজ সম্পর্কে --

টি. টি. জিয়োন
২০১২ সালে লাস ওলাস বোউলভার্ডের পশ্চিমে ফোর্ট লউডার্ডেল বীচের কাছে খুঁজে পাওয়া যায় জাহাজটিকে। আর দশটা জাহাজের মতনই দেখতে ছিল সেটি। তবে অন্যদের চাইতে অনেক বেশি সুসজ্জিতই ছিল তা। বিশাল এই জাহাজটিতে যে একটা জিনিসের অভাব একে করে দিয়েছিল পৃথিবীর কাছে রহস্যময়তার আধার সেটি হচ্ছে এর যাত্রী। অদ্ভূত শুনতে হলেও সত্যি যে এতবড় একটি জাহাজে ছিল না কোন মানুষ কিংবা মানুষের চিহ্ন! সম্পূর্ণ খালি জাহাজ টি. টি. জিয়োনের ভেতরে মালিকের মানিব্যাগ আর মোবাইল খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল যদিও। তবে সে সূত্র ধরে খুব বেশিদূর এগোতে পারেনি গোয়েন্দারা। রহস্য রয়ে গিয়েছে রহস্যই!

ইয়ং টেজার
১৮১৩ সালে নোভা স্কোটিয়ার মেরিন বে-তে নিজের ক্রুমেটরাই ধ্বংস করে ইয়ং টেজার স্কুনারটি। ঘটনাটি তখনই শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু একে একটু বেশি সবার নজড়ে আসে সবার, যখন ধ্বংস হওয়ার পরেও আবার তা দেখতে পাওয়া যায়। পরবর্তী দুই বছরে নিয়মিত মানুষ দেখতে লাগল স্কুনারটিকে। অনেকে বলে ধ্বংসস্থলের কাছেই আগুনের কুন্ডলীর ভেতরে হাওয়া হয়ে যেত এটি কখনও কখনও। তাও আবার অনেক মানুষের সামনে। রহস্যময় এই জাহাজের কাছ থেকে নাম ধার নিয়ে এ স্থানের একটি রহস্যময় কুয়াশার নামও রাখা হয়েছে টেজার লাইট!

জেব্রিনা
১৯১৭ সালে ফ্রান্স থেকে জেব্রিনা নামের বজরাটি চলতে শুরু করে এবং এর খানিক বাদেই এর সব আরোহী উধাও হয়ে যায়। সেসময় এর ভেতরে ছিল মোট ৫ জন মানুষ। মনে করা হয় জার্মান এই ইউ বোট এসে এর মানুষগুলোকে পাকড়াও করে নিয়ে যায়। তবে ইতিহাসে যেটাই হয়ে থাকুক না কেন, রহস্যময় জাহাজের তালিকায় নাম উঠে এসেছে জেব্রিনারও।

এস ভি লুনাটিক
২০০৭ সালে ৭০ বছর বয়স্ক জুর স্টের্ক নিজের নৌকা লুনাটিককে নিয়ে পৃথিবী ভ্রমণে বেড়িয়ে পড়েন। ডাঙার সঙ্গে যোগাযোগের জন্যে তার কাছে ছিল মিশ্রমানের একটি রেডিও। তবে ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি হঠাৎ করে তার রেডিও থেকে সংকেত পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়। এর অনেকদিন পর লুনাটিককে অস্ট্রেলিয়ায় খুঁজে পাওয়া যায়। তখন এর ভেতরে জুর কিংবা অন্য কোনো যাত্রীই ছিল না। এর প্রায় তিন মাস পরে একই নৌকাকে দেখতে পাওয়া যায় সমুদ্রের মাঝখানে ভাসতে। তবে তখনো কোন নাবিক ছিল না এতে।

কাজ ১১
৩৩ ফুটের এই কাটামারানটিকে খুঁজে পাওয়া যায় ২০০৭ সালে। অস্ট্রেলিয়ার সৈকত থেকে ৮৮ নটিকাল মাইল দূরে ছিল তখন এটি। নৌকাটির রেডিও কাজ করছিল। কম্পিউটার চলছিল। লাইফ জ্যাকেটসহ আরোসব সুবিধা ছিল তখনো সেখানে। আর কোন রকম ঝামেলা বা ধস্তাধস্তি- কোন চিহ্নই ছিল না এতে। সবচাইতে অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে নৌকার ডাইনিং টেবিলটিও ছিল খাবার শুরুর আগমুহূর্তের মতন করে সাজানো। তবে যেটা ছিল না সেখানে সেটা হচ্চে নাবিক বা কোনো আরোহী। তথ্যমতে ছাড়বার সময় নৌকায় ছিল তিনজন মানুষ। তবে খুঁজে পাওয়ার সময় সেখানে ছিল না কেউই। যেন খাবার টেবিলে বসার আগমুহূর্তে টেবিল থেকে স্ব-ইচ্ছায় চলে গিয়েছিলেন তারা। কিন্তু কেন? এখনো পাওয়া যায়নি এ প্রশ্নের উত্তর।

জিয়ান সেঙ
২০০৬ সালের ঘটনা এটি। এবারেও ঘটনার কেন্দ্রস্থল অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়ার সৈকতে সেবার খুঁজে পাওয়া যায় নামবিহীন এক জাহাজকে। চিনতে পারার মতন কোন কিছু ছিল না এতে। মানুষ তো ছিলই না। মনে করা হয় সমুদ্রপথে মানব পাচার বা মাদক পাচার কিংবা মাছের অবৈধ ব্যবসা থেকে শুরু করে যে অপরাধগুলো করা হয় সেগুলোর জন্যেই ব্যবহৃত হত এই জাহাজটি। পরে বিপদ বুঝতে পেরে নৌকাটির মালিকেরা তা ভাসিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এই ধারনাতে মস্ত একটা বিষ্ময় চিহ্ন এঁকে দেয় কেবল একটি প্রশ্ন। আর সেটি হচ্ছে এর ভেতরে থাকা প্রচুর পরিমাণ চাল। কে এরকম ফাঁকা একটা জাহাজে এত চাল ভরে ভাসিয়ে দেবে সমুদ্রে? প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি। তবে পরবর্তীতে মালিকানা না থাকায় ডুবিয়ে দেওয়া হয় জাহাজটিকে।

ওরাঙ মেডান
১৯৪৭ সালে এই ডাচ কার্গো জাহাজটিকে ইন্দোনেশিয়ার কাছে খুঁজে পাওয়া যায়। এর সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও কেবল ঠিক ছিল না এর যাত্রীরা। অন্য জাহাজগুলোর মতন হাওয়া হয়ে যায়নি এর যাত্রীরা। বহাল তবিয়তেই জাহাজের ভেতরে ছিলেন তারা। তবে তাদের সবাইই ছিলেন মৃত। শরীরে কোনরকম আঘাত চিহ্ন ছিল না তাদের শরীরে। তবে মৃত্যদের মুখ ভঙ্গীতে ছিল ভয়।

উদ্ধারের পর কার্গোটিতে দুটো বার্তা পাওয়া যায়। তার একটি ছিল- ‘নাবিকসহ সব কর্মকর্তা চার্টরুম ও ব্রিজে মরে পড়ে আছেন। সম্ভবত সব নাবিকই মৃত।’ আর পরের বার্তাটি ছিল- ‘আমি মারা যাচ্ছি।’ ধারনা করা হয়, কার্গোটিতে সালফিউরিক এসিড নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। যেটা হঠাৎ করেই বেড়িয়ে যায় আর সব নাবিক মারা যায় এতে।

বেল আমিকা
২০০৬ সালে সার্দানিয়া দ্বীপের কাছে খুঁজে পাওয়া যায় বেল আমিকাকে। আরো অন্য ভূতুড়ে জাহাজগুলোর মতন এতেও কোন মানুষ ছিল না। ছিল অর্ধেক খাওয়া মিশরীয় খাবার, উত্তর আফ্রিকার সাগরের একটি ফ্রেঞ্চ মানচিত্র এবং লুক্সেমবার্গের পতাকা। অবস্থা দেখে অনেকের মনে হয়েছিল এ যেন এখনকার কোন জাহাজ নয়। কোন দেশের কাছে আমিকার রেজিস্ট্রেশন করা ছিল না। কোন মালিকানা ছিল না এর। তবে কি হাজার হাজার বছর ধরেই ভাসছে এই জাহাজ? প্রশ্ন জেগে উঠেছিল সবার মনে। তবে পরে জানা যায় যে এটি আসলে অতি ধনী এক মানুষ তার কালো টাকা খরচ করতে কিনে নিয়েছিলেন কোন রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই!

ক্যারোল এ. ডেরিং
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের নাম শোনেননি এমন মানুষ খুব কমই আছেন। আর রহস্যের আধার এই বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলেই রহস্যের চাদর গায়ে জড়ায় ডেরিং নামের জাহাজটি। ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো থেকে যাত্রা শুরু করার পর মাঝ পথে সামান্য কিছু ঝামেলা হলেও সেসব ঠিক হয়ে যায় জাহাজটিতে। পরবর্তিতে ১৯২১ সালের ২৮ জানুয়ারি সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় জাহাজটি। তিনদিন পর কেপ হেটারসে একে খুঁজে পায় উদ্ধারকারী দল। জাহাজটিতে তখন কোন মানুষ ছিল না। ধারণা করা হয়, খাবার টেবিল থেকেই উধাও হয়ে গিয়েছিল যাত্রীরা। কি হয়েছিল ওখানে? কেনই বা এভাবে হঠাৎ সবাই উধাও হয়ে যায়, তা জানা যায়নি আজও।

লেডি লভিবন্ড
১৭৪৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারিতে নিজের বিয়ের খুশি উদযাপন করতে লভিবন্ডে নিজের স্ত্রী আর ফার্স্ট মেট জন রিভার্সকে নিয়ে সাগরে বেড়িয়ে পড়েন ক্যাপ্টেন সিমন রিড। তবে তিনি জানতেন না যে তার স্ত্রীকে নিয়ে তার প্রতি ঠিক কতটা ঈর্ষায় ভুগছিলেন রিভার্স। খুশির একটি মুহূর্তে সেই ঈর্ষা থেকেই জাহাজের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়ে সেটিকে ধ্বংস করে ফেলেন রিভার্স। মারা যান সবাই। এর ৫০ বছর পরের কথা। হঠাৎ করে আবার লেডি লভিবন্ডকে দেখতে পাওয়া যায় সাগরে। তার ৫০ বছর পর আবার একই জায়গায় দেখা যায় একে। ঠিক একই ঘটনা ঘটে এর ৫০ বছর পরেও। তবে এভাবে প্রতি ৫০ বছর পরপর ভূতুড়ে জাহাজটিকে দেখতে পাওয়া গেলেও এরপর একেবারে অদৃশ্য হয় যান লভিবন্ড।

এমভি টাই চিং ২১
সাধারনত জাহাজে কোন সমস্যা হলে সেটি তীরে খবর পাঠায়। কিন্তু তাইওয়ানের এই জাহাজটিতে আগুন লাগার চিহ্ন থাকলেও কোনরকম বার্তা পাওয়া যায়নি এর কাছ থেকে। ২০০৮ সালের অক্টোবরে বেড়িয়ে পড়ে টাই চিং যেটিকে পরের মাসেই একেবারে খালি অবস্থায় দেখা যায়। সেখানে ছিল না কোন লাইফ বোট বা জ্যাকেটও। মনে করা হয় এর যাত্রীরা ওগুলো নিয়ে পালিয়ে গিয়েছে আগুন থেকে বাঁচতে। কিন্তু সমুদ্র তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তাদের কাউকে পাওয়া যায়নি তেমন কোনো প্রমাণ।

হাই এইম ৬
২০০৩ সালে আরেকটি তাইওয়ানের জাহাজ খুঁজে পাওয়া যায় অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্রে। এবং অন্য জাহাজগুলোর মতন এতেও কোন মানুষ ছিল না। টানা ১০ দিন ধরে এর যাত্রীদের খোঁজ করা হয়। অবশেষে পাওয়া যায় এক নাবিককে। তিনি জানান, এর ক্যাপ্টেন আর নাবিকদের ভেতরের যুদ্ধে মারা যায় সবাই। কিন্তু পর্যাপ্ত খাবার, জ্বালানী থাকা সত্ত্বেও কেন এমন ঘটনা ঘটে ছিল সে বিষয়ে কোনো তথ্য জানা যায়নি আজও।

স্কুনার জেনি
১৮২৩ সালে জেনি থেকে ক্যাপ্টেন নিজের জার্নালে একটি বার্তা লেখেন। সেটি হচ্ছে-
‘৭১ দিন ধরে খাবার নেই। আমি একা বেঁচে আছি’। এর প্রায় ১৭ বছর পরে খুঁজে পাওয়া যায় জাহাজটিকে। অ্যন্টার্কটিকার প্রচন্ড ঠান্ডায় তখন জমে গিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন। বরফ হয়ে যাওয়া ক্যাপ্টেন তখনও বসে ছিলেন চেয়ারে। আর তার হাতে ধরা ছিল কলম। পরে ক্যাপ্টেনের মরদেহ উদ্ধার করে যথাযোগ্য মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।

কোবেনহ্যাভেন
কোবেনহ্যাভেন জাহাজটি মূলত নাবিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হত। শেষ ১৯২৮ সালে প্রশিক্ষণের কাজে বের হয় এটি। এরপর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি তার। বেশকিছুদিন পরে অবশ্য একে পাওয়া যায় এবং ধারনা করা হয় যে এর ৭৫ জন মানুষ সাগরে একটি আইসবার্গে ধাক্কা খায়। তবে ঘটনা তখনই শেষ হয়নি। এরপর বেশ কয়েকবার একই স্থানে হুবহু একই রকমের জাহাজ দেখা গেছে বেশ কয়েকবার। সেই থেকেই এর নামের সাথে জুড়ে গিয়েছে ভূতুড়ে তকমাটি।

রৌজ সিমনস
১৯১২ সালে ক্রিসমাস ট্রি বহন করা এই কার্গো জাহাজটি ঝড়ের কবলে পড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। এর অনেক পরের কথা। হঠাৎ করেই দেখা যায় জাহাজটিকে। মারা যাওয়ার আগে একটি বার্তা লিখে বোতলে করে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন এক জন নাবিক। সেই বার্তা, হঠাৎ হঠাৎ দেখতে পাওয়া জাহাজ আর জ্বলে ওঠা ক্রিসমাস ট্রি- সবমিলিয়ে ভূতুড়ে করে একটি কাহিনি তৈরি হয় জাহাজটি নিয়ে।
Blogger দ্বারা পরিচালিত.